অভিমানী পদার্থবিজ্ঞানী বোলজম্যান

উনিশ শতকে প্রকৃতির রহস্য উদঘাটনে পদার্থবিজ্ঞানের যেসব সৈনিক নিরলস কাজ করেছেন তাদের একজন হলেন লুডভিগ বোলজম্যান। পুরো নাম লুডভিগ এডুয়ার্ড বোলজম্যান। এক ট্যাক্স কালেক্টরের সন্তান বোলজম্যান ছিলেন ছোটখাটো ও মোটাসোটা মানুষ। মুখে উনিশ শতকের শেষদিকের প্রচলিত চমত্কার দাড়ি। মুখজুড়ে জঙ্গলের মত ঘন ও বিশাল দাড়ির কারণে তাঁকে প্রথম দেখায় দুর্ধর্ষ আর ভয়ানক মানুষ বলে ভুল ধারণা জন্মাতে পারে। কিন্তু তাঁর চেহারা দেখে বোঝা সম্ভব নয়, বিভিন্ন আইডিয়া রক্ষার জন্য লড়াই করতে পুরো জীবনে তাঁকে কতটা ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে।

উনিশ শতকেও নিউটোনিয়ান পদার্থবিদ্যা বেশ ভালভাবে রাজত্ব করছিল। কিন্তু বোলজম্যান জানতেন, এই সূত্রগুলোকে কখনো পরমাণুর মতো সেকালের বিতর্কিত ধারণায় ব্যবহার করা যাবে না। বিতর্কিত কারণ, পরমাণুর ধারণা তখনও সেকালের শীর্ষ বিজ্ঞানীরা মেনে নেননি। এক শতাব্দী আগেও বেশ বড় সংখ্যক বিজ্ঞানী জোরের সাথে বলতেন, পরমাণু হলো কেবলই চতুর একটা কৌশল, এর বাস্তব কোনো অস্তিত্ব নেই। পরমাণু এতই অসম্ভবরকম ক্ষুদ্র যে, এদের সত্যিকার কোন অস্তিত্ব নেই বলে দাবি করতেন তাঁরা।

১৮৪৪ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায় জন্ম বোলজম্যানের। কোয়ান্টাম তত্ত্বের জনক ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের মতো তিনিও ভালো পিয়ানো বাজাতে পারতেন। একসময় অস্ট্রিয়ান নামকরা কম্পোজার আন্তন ব্রুকনারের কাছে পিয়ানো শেখেন বোলজম্যান। তবে ভালো পিয়ানিস্টের চেয়েও তিনি ছিলেন ভালো ও দক্ষ একজন পদার্থবিদ। ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন ১৮৬৬ সালে। গ্যাসের গতি তত্ত্ব নিয়ে মৌলিক অবদান রেখে অচিরেই সুনাম অর্জন করেন। এ তত্ত্বের সমর্থকদের বিশ্বাস ছিল, গ্যাস একটি ক্রমাগত গতিশীল অবস্থায় পরমাণু বা অণু দিয়ে গঠিত। ১৮৮৪ সালে বোলজম্যানের এই মতবাদের তাত্ত্বিক প্রমাণ হাজির করেন তাঁর সাবেক গুরু জোসেফ স্টিফান। তিনি প্রমাণ করেন, একটি কৃষ্ণবস্তু থেকে নিঃসৃত সর্বমোট শক্তি হল তাপমাত্রার চতুর্থ ঘাতের সমানুপাতিক, বা T4 বা T×T×T×T। এর মানে হলো, কৃষ্ণবস্তুর তাপমাত্রা দ্বিগুণ করা হলে তার বিকিরিত শক্তির পরিমাণ হবে ১৬ গুণ।

নামকরা অধ্যাপক ও তাত্ত্বিক হওয়ার পাশাপাশি বোলজম্যান পরীক্ষা-নিরীক্ষাতেও ছিলেন সিদ্ধহস্ত। তার ক্ষীণ দৃষ্টিশক্তি এ কাজে কোনো বাধার সৃষ্টি করতে পারেনি। ইউরোপের, বিশেষত জার্মানির শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যখনই কোনো পদ ফাঁকা হত, তখনই সে পদের সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে বোলজম্যানের নাম ওঠা একসময় রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। গুস্তাভ কার্শফের মৃত্যুর পর বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে তার পদটি ফাঁকা হলেও তাঁর নাম প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু সে প্রস্তাব তিনি প্রত্যাখান করায় পর কিছুটা নিচের পদে প্ল্যাঙ্ককে প্রস্তাব করা হয়েছিল। পরে অবশ্য তাঁর ছাত্রী লিজে মাইটনারের কাছে এক আলাপে এ পদটি না নেওয়ায় আফসোস করেন বোলজম্যান। এই ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ে একসময় তারই শিক্ষার্থী ছিলেন লিজে। অনেক জায়গায় ঘোরাঘুরির পর ১৯০০ সালের দিকে জার্মানির লিপজিগ বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থিতু হন বোলজম্যান। দুই বছর আবারও ফিরে যান ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ে। জার্মানির কেন্দ্র থেকে বরাবরই অনেক দূরে থাকলেও এই প্রতিভাবান ও মেধাবী তাত্ত্বিকের কথা সবার জানা ছিল। কিন্তু প্ল্যাঙ্কের মতো আরও অনেকেই তার তাপগতিবিদ্যা সংক্রান্ত মতবাদে গ্রহণযোগ্য মনে করতেন না।

নিউটন প্রমাণ করেন, কোন আত্মা বা ইচ্ছাশক্তি নয়, বরং সকল বস্তুর গতি নির্ধারণের জন্য যান্ত্রিক বলই যথেষ্ট। বোলজম্যান এরপর একটি সরল অনুমানের ভিত্তিতে গ্যাসের বেশ কিছু অভিজাত সূত্র প্রতিপাদন করেন। তিনি বলেন, গ্যাসসমুহ আসলে অতিক্ষুদ্র পরমাণু দিয়ে গঠিত, অনেকটা বিলিয়ার্ড বলের মতো। এসব পরমাণু নিউটনের বলের সূত্রগুলো মেনে চলে। বোলজম্যানের কাছে গ্যাস ভর্তি কোন চেম্বারের অর্থ ছিল ট্র্রিলিয়ন-ট্রিলিয়ন অতিক্ষুদ্র বল ভরা একটা বাক্স। এসব বল বাক্সের দেয়ালে এবং সেই সাথে পরস্পরের সাথে ধাক্কা খায় নিউটনের গতির সূত্র মেনে। বোলজম্যান (ও জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েলও স্বাধীনভাবে প্রমাণ করেছেন) গাণিতিকভাবে প্রমাণ করেন, এই সরল অনুমান থেকে কীভাবে চোখ ধাঁধানো নতুন সূত্র পাওয়া যায়। সেই সঙ্গে পদার্থবিজ্ঞানের নতুন শাখার জন্ম দেয়। এ শাখাটির নাম স্ট্যাটিস্টিকেল মেকানিকস বা পরিসংখ্যানিক বলবিদ্যা। পদার্থবিজ্ঞানের অন্যতম সেরা মাস্টারপিস বলা হয় একে।

বোলজম্যানের বিশ্বাস, গ্যাসের ধর্মগুলো (যেমন চাপ) হলো মাইক্রোস্কোপিক বা অতিক্ষুদ্র পরিসরের পরিঘটনা, যা বলবিদ্যা ও সম্ভাবনা সূত্রের মাধ্যমে ম্যাক্সোস্কোপিক বা বড় পরিসরের ঘটনা হিসেবে প্রকাশিত হয়। যারা পরমাণুতে বিশ্বাস রাখতেন, তাদের অনেকে প্রতিটি গ্যাসের অণু চলাচল নিউটনের চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞানের অধীন বলেও মনে করতেন। কিন্তু বাস্তবে নিউটনের গতির সূত্রগুলো দিয়ে গ্যাসের অসংখ্য অণুর মধ্যে প্রতিটির গতি নির্ধারণ করা একেবারেই অসম্ভব। এর আগে ১৮৬০ সালে ২৮ বছর বয়সে স্কটিশ পদার্থবিদ জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল গ্যাসের অণুগুলোর গতি পরিমাপ করেছিলেন, কোন একক অণুর গতি পরিমাপ না করেই। সেজন্য পরিসংখ্যান ও সম্ভাবনা তত্ত্ব ব্যবহার করেন ম্যাক্সওয়েল। খুব সম্ভবত একটা কন্টেইনারের দেয়ালে পরস্পরের সাথে নিরবিচ্ছিন্ন সংঘর্ষে লিপ্ত গ্যাসের অণুগুলোর গতির বণ্টন নির্ণয় করেন তিনি। এক্ষেত্রে পরিসংখ্যান ও সম্ভাবনা তত্ত্বের ব্যবহার ছিল সাহসী ও সৃজনশীল। এর মাধ্যমে ম্যাক্সওয়েল গ্যাসের পর্যবেক্ষণকৃত অনেকগুলো ধর্মের ব্যাখ্যা দিতে পেরেছিলেন। গ্যাসের গতি তত্ত্ব প্রতিপাদনের জন্য ম্যাক্সওয়েলের পদাঙ্ক অনুসরণ করেন তার চেয়ে বয়সে ১৩ বছরের ছোট বোলজম্যানও। ১৮৭০-এর দশকে তিনি এক ধাপ এগিয়ে এনট্রপির সাথে বিশৃঙ্খলার সংযোগ স্থাপন করে তাপগতিবিদ্যার পরিসংখ্যানগত ব্যাখ্যা হাজির করেন।

এটি বোলজম্যানের নীতি হিসেবে পরিচিত। এ নীতি অনুযায়ী, একটি নিদিষ্ট অবস্থায় থাকা সিস্টেমে খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা পরিমাপ হলো এনট্রপি। যেমন ভালভাবে বেটে নেওয়া এক প্যাকেট তাস হল বিশৃঙ্খল সিস্টেম, যার এনট্রপি অনেক বেশি। তবে টেক্কা থেকে রাজা পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে সঠিকভাবে সাজানো নতুন এক প্যাকেট তাস হলো উচ্চমাত্রার শৃঙ্খলাবদ্ধ সিস্টেম। এর এনট্রপি অনেক কম। বোলজম্যানের জন্য তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্রটি ছিল একটি নিম্ন সম্ভাবনার সিস্টেমের বিবর্তন। সহজ কথায়, নিম্ন এনট্রপি থেকে একটি উচ্চতর সম্ভবনা ও উচ্চ এনট্রপির সিস্টেমের দিকে বিবর্তন। তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্র কোন পরম সূত্র নয় (কিন্তু প্ল্যাঙ্ক ভাবতেন উল্টোটা)। একটি সিস্টেম বিশৃঙ্খল অবস্থা থেকে অনেক বেশি শৃঙ্খলার দিকে যাওয়ারও সম্ভবনা থাকে। যেমন এক প্যাকেট বাটা তাসকে যদি আবারও বাটা হয়, তাহলে সেটি হয়ত শৃঙ্খলায় ফিরে আসতে পারে। তবে মহাবিশ্বের ক্ষেত্রে এরকম বিপরীতমুখী ঘটনা ঘটার জন্য অনেক অনেক সময়ের প্রয়োজন।

কোন গ্যাসের এনট্রপি গণনার জন্য বোলজম্যানের ধারণাটি ছিল বেশ সরল। শুরুতে তিনি ধরে নেন, এর সর্বমোট প্রাপ্ত শক্তি এক সারি বালতি বা পাত্রের মধ্যে বিন্যাস্ত আছে। সর্বনিম্ন শক্তিস্তরের বালতিটিকে শক্তি E হিসেবে ধরে নেওয়া যাক। পরেরটির শক্তি 2E, তারপরেরটি 3E এবং এভাবে বাকিগুলো চলতে থাকবে। এখন গ্যাসের অণুগুলোকে ওই বালতির মধ্যে বণ্টন করা যাক। সেইসঙ্গে বালতির মধ্যকার অণুগুলোর বিভিন্ন সম্ভাব্য পারমুটেশন বা বিন্যাস হিসেব করতে হবে। এই বিশ্লেষণে শক্তি নিজেই অবিরামভাবে চলক বা পরিবর্তনশীল হিসেবে বর্তমান। বোলজম্যান একে এভাবে প্যাকেটের মতো মোড়কে আবদ্ধ করলেন, যাতে তিনি শূন্য থেকে E পর্যন্ত, E থেকে 2E পর্যন্ত ও তারপরের শক্তির পরিসরের মধ্যে অণুর সংখ্যা গণনা করতে পারেন। একইসঙ্গে যাতে ভিন্ন ভিন্ন সম্ভাব্য বিন্যাস সংখ্যাও গণনা করা যায়।

ধরা যাক, একটা গ্যাসে মাত্র তিনটি অণু আছে। এদেরকে আমরা a, b ও c হিসেবে চিহ্নিত করলাম। এবার অনুমান করা যাক, এই গ্যাসের সর্বমোট শক্তির পরিমাণ 4ε। আমরা দুটি অণুকে সর্বনিম্ন শক্তিস্তরের ε বালতিতে এবং একইভাবে আরেকটিকে 2ε বালতিতে রেখে এতে পৌঁছাতে পারি। তাহলে এখানে কতগুলো বিন্যাসে সাজানো যাবে? উত্তর হলো, মাত্র তিনটি। আমরা a ও b অণুকে সর্বনিম্ন শক্তির বালতির মধ্যে রাখতে পারি এবং c-কে রাখতে পারি পরের বালতিতে। সেক্ষেত্রে অণুর বিন্যাস পাওয়া যাবে [ab, c]। আবার a ও c অণুকে সর্বনিম্ন শক্তিস্তরের বালতিতে রাখা যায় এবং এবং b-কে রাখা যায় পরেরটিতে। তাহলে এখানে বিন্যাস পাওয়া যাবে [ac, b]। একইভাবে তৃতীয় সম্ভাব্য বিন্যাসটি হবে [bc, a]।

বোলজম্যান যুক্তি দেখালেন, গ্যাসের সবচেয়ে সম্ভাব্য অবস্থা সেটাই হবে, যার মধ্যে প্রাপ্ত শক্তির সর্বোচ্চ সংখ্যক সম্ভাব্য বিন্যাস থাকবে। ওই শক্তিই সর্বোচ্চ এনট্রপির প্রতিনিধিত্ব করবে। সর্বোচ্চ সংখ্যক সম্ভাব্য বিন্যাসের সাথে শক্তির সবচেয়ে সম্ভাব্য বন্টন সমকক্ষ হিসেবে বর্ণনা করে তুলনামূলক সহজে খোদ এনট্রপির হিসেব করা যায়। কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণ সংক্রান্ত সমস্যা সমাধান করতে গিয়ে বোলজম্যানের এই গণনা পদ্ধতির দ্বারস্থ হতে বাধ্য হয়েছিলেন পদার্থবিদ ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক। এভাবেই চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞানকে ভেঙেচুরে কোয়ান্টাম তত্ত্বে পৌঁছান তিনি।

উনিশ শতকেও পরমাণুর অস্তিত্ব নিয়ে তখনও ভয়ানক বির্তক চলছিল। সেকালের নামকরা বিজ্ঞানীরা, যেমন দার্শনিক আর্নেস্ট মাখ তা নিয়ে প্রায়ই বিদ্রুপ করতেন। অভিমানী আর প্রায়ই বিষাদগ্রস্ত মানুষ বোলজম্যান তার সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হন। পরমাণুবাদ বিরোধীরা প্রায়ই তাকে ভয়াবহভাবে আক্রমণ করত। পরমাণুবাদ বিরোধীদের মতে, যে জিনিস পরিমাপ করা যায় না, তার কোন অস্তিত্বও নেই। বোঝাই যাচ্ছে, তাঁদের বাতিল তালিকার মধ্যে পরমাণুও ছিল। বোলজম্যানের জন্য আরও ভয়াবহ অবমাননাকর ব্যাপারটা ছিল, তাঁর বেশকিছু গবেষণাপত্র বাতিল হয় সেকালের নামকরা কিছু জার্মান পদার্থবিজ্ঞান জার্নালগুলোতে। এ সম্পর্কে অভিযোগের তীর প্ল্যাঙ্কের দিকেও তোলেন কেউ কেউ।

একের পর এক ব্যক্তিগত আক্রমণে ক্লান্তি আর তিক্ততায় একসময় চরম হতাশায় ডুবে যান বোলজম্যান। অনেকদিন ধরে অসুস্থও ছিলেন। হাপানি, মাইগ্রেন, ক্ষীণ দৃষ্টি আর হৃদরোগে ভুগতে ভুগতে শারীরীক ও মানসিকভাবেও দুর্বল হয়ে পড়েন তিনি। এগুলোর চেয়ে তাঁকে চরমভাবে দুর্বল করে দিয়েছিল বিষণ্ণতা। এ অবস্থায় চাকরি থেকেও অবসর নিতে বাধ্য হন তিনি। এর চার মাস পর সবকিছু থেকে মুক্তি পেতে একদিন এক ছুটির দিনে নিঃসঙ্গ অবস্থায় আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। তাঁর বয়স তখন ৬২ বছর। ১৯০৬ সালের ৫ সেপ্টেম্বরে তাঁর লাশ যখন উদ্ধার করা হয়, তখন তাঁর পাশে পরিবারের কেউই ছিল না। তাঁর কাছ থেকে অনেক দূরে ত্রিস্তের কাছে দুইনোতে তার স্ত্রী ও সন্তানরা সাগরতীরে অবসর সময় কাটাচ্ছিল।

তাঁর কয়েকজন বন্ধু অনেক দিন ধরে খারাপ একটা সংবাদের আশঙ্কা করছিলেন। সেই আশঙ্কাই এভাবে একদিন সত্য হয়ে গেল। তাঁর মৃত্যু সংবাদ ছিল তাঁদের জন্য চরম আঘাত। আসলে অনেকদিন ধরেই বোলজম্যান বিচ্ছিন্নতা বোধে আক্রান্ত ছিলেন। পাশাপাশি যোগ্য সম্মানও পাননি বলে মনে করতেন তিনি। কিন্তু এর সবটাই সত্য নয়। আসলে তাঁর সময়ের সবচেয়ে সম্মানিত ও প্রশংসিত পদার্থবিদ ছিলেন তিনি। কিন্তু পরমাণুর অস্তিত্ব নিয়ে দীর্ঘদিনের চলমান বির্তক, তাঁর মনে এই অনুভূতির সৃষ্টি করেছিল, তাঁর সারা জীবনের কাজের কোন মূল্যায়ন হয়নি। ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯০২ সালে বোলজম্যান তৃতীয় ও শেষবারের মতো ফিরে আসেন। সেসময় নিজের পদে বোলজম্যানকে বসানোর প্রস্তাব ও আমন্ত্রণ দেন প্ল্যাঙ্ক। বোলজম্যানের কাজকে তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যার গবেষণায় সবচেয়ে চমত্কার সাফল্য হিসেবে বর্ণনা করে এই একগুয়ে ভিয়েনাবাসীকে এখানে আসতে রাজি করাতে চেষ্টা করেন। কিন্তু তা প্রত্যাখান করেন বোলজম্যান।

বোলজম্যানের কাছে ঋণ সম্পর্কে সচেতন ছিলেন প্ল্যাঙ্ক। তাই এই অস্ট্রিয়ানের নামে k ধ্রুবকটির নামকরণ করেন তিনি। কৃষ্ণবস্তুর সূত্র নিয়ে গবেষণা করতে গিয়েই তিনি ধ্রুবকটি একদিন আবিষ্কার করেন। বোলজম্যানের নাম নোবেল পুরস্কারের জন্যও ১৯০৫ এবং ১৯০৬ সালে প্রস্তাব করেন প্ল্যাঙ্ক। কিন্তু ততদিনে আসলে অনেক দেরি হয়ে গেছে। একরাশ অভিমান নিয়ে আত্মহত্যা করে সবকিছুকে মূল্যহীন প্রমাণ করে ততদিনে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন বোলজম্যান।

দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হলো, মৃত্যুর আগে তিনি হয়ত জেনে যেতে পারেননি, মাত্র এক বছর আগে, আলবার্ট আইনস্টাইন নামের এক বেপরোয়া তরুণ পদার্থবিদ সেই অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলেছিলেন। পরমাণুর অস্তিত্বের প্রমাণ দিয়ে প্রথম একটা গবেষণা প্রবন্ধ লিখেছিলেন তিনি। তারপরের পরমাণুর ইতিহাস তো পদার্থবিজ্ঞানেরই ইতিহাস।

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, বিজ্ঞানচিন্তা

সূত্র:

কোয়ান্টাম তত্ত্বের জনক ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক/ আবুল বাসার, বাতিঘর, ঢাকা (২০২১)

কোয়ান্টাম: আইনস্টাইন, বোর অ্যান্ড দ্য গ্রেট ডিবেট অ্যাবাউট দ্য নেচার অব রিয়েলিটি/ মনোজিত কুমার, আইকন বুকস, যুক্তরাজ্য (২০০৯)

উইকিপিডিয়া