২০০৭ সালের ২০-২৩ আগস্ট সেনা সমর্থিত তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ছাত্র, শিক্ষক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পারিবারের ওপর হামলা চালায়। অত্যন্ত নিন্দনীয় ওই ঘটনার প্রতিবাদে গত ১৫ বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা প্রতিবছর ২৩ আগস্টকে ‘কালো দিবস’ হিসেবে পালন করে আসছেন।জানা যায়, ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি জরুরি আইন জারির পরে সেনাবাহিনী সারা দেশে বিভিন্ন স্থানে ক্যাম্প স্থাপন করে এবং দেশের রাজনৈতিক নৈরাজ্যের সুযোগ নিয়ে সেনা সদস্যদের কেউ কেউ শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে নিপীড়ন, নির্যাতন চালায়। উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিদের মাঝে সামরিক রাজনীতির আভাস ছাত্র-শিক্ষকরা দেখতে পায়। ওই বছরের ২০ আগস্ট ঢাবিতে খেলার মাঠে ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে উপস্থিত ছাত্র ও সেনা সদস্যদের মধ্যে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। এতে শিক্ষার্থীদের ওপর নির্মম নির্যাতন চালান সেনা সদস্যরা।
এ ঘটনার প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক মোবাশ্বের মোনেমকে সেনা সদস্যরা শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেন। এ ঘটনা ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে গেলে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভে ফেটে পড়েন শিক্ষার্থীরা। ছাত্রদের কাছে সেনা সদস্যদের ক্ষমা চাওয়ার দাবি ওঠে। কিন্তু সেনাবাহিনী তা মেনে নেয়নি। পরে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহারসহ ওই ঘটনায় জড়িত সেনা কর্মকর্তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করা হয়।
এ ঘটনার পরদিন ২১ আগস্ট নির্যাতনের প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। স্বতঃস্ফূর্তভাবে তারা বিক্ষোভ করতে থাকেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে। তখন তাদের ওপর হামলা চালায় পুলিশ। নীলক্ষেত, টিএসসি, কার্জন হল এলাকাসহ ক্যাম্পাস পরিণত হয় রণক্ষেত্রে। পুলিশের টিয়ারশেল ও রাবার বুলেটে আহত হন শতাধিক ছাত্র। আন্দোলনের মুখে বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরিক শিক্ষাকেন্দ্র থেকে ক্যাম্প সরিয়ে নিতে বাধ্য হয় সেনাবাহিনী।
পরদিন ২২ আগস্ট এই আন্দোলন গোটা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছড়িয়ে পড়ে। রাজশাহীতে পুলিশের গুলিতে নিহত হন রিকশাচালক আনোয়ার। পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে উঠলে তৎকালীন সেনা-তত্ত্বাবধায়ক সরকার সেই দিনই বিভাগীয় শহরগুলোতে কারফিউ জারি করে। ওইদিন সন্ধ্যার মধ্যেই ঢাবির আবাসিক ছাত্র-ছাত্রীদের হল ছাড়ার নির্দেশ দেয়া হয়।
এরপর ২৩ আগস্ট রাতে আটক করা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন ও অধ্যাপক হারুন-অর-রশিদকে। তাদের চোখ বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয় অজানা স্থানে। এ ছাড়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) শিক্ষক সাইদুর রহমান খান, আবদুস সোবহান, মলয় কুমার ভৌমিক, দুলাল চন্দ্র বিশ্বাস, আবদুল্লাহ আল মামুন এবং সেলিম রেজা নিউটনকে গ্রেফতার দেখানো হয়। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সংহতি প্রকাশের অভিযোগে তাদের গ্রেফতার করা হয়। পরে ঢাবির আরও দুই শিক্ষক ও ৩ ছাত্রনেতাকে গ্রেফতার করে সেনা সমর্থিত সরকার। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
দীর্ঘ ৬৬ দিন পর খুলে দেয়া হয় ঢাবি ও রাবি ক্যাম্পাস। প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলো নির্যাতনবিরোধী ব্যানারে মাঠে নামে। ধীরে ধীরে গ্রেফতারকৃতদের মুক্তির আন্দোলনও বেগবান হতে থাকে। পরে আরও দুটি ব্যানারে ছাত্রবন্ধু ও নির্যাতন প্রতিরোধ ছাত্র আন্দোলন ছাত্র-শিক্ষক মুক্তির আন্দোলনে গতির সঞ্চার করেছিল। ছাত্র-শিক্ষকদের মুক্তি আন্দোলনের কাছে হার মানে সেনাসমর্থিত সরকার। বাধ্য হয়ে গ্রেফতারকৃত ছাত্র-শিক্ষকদের মুক্তি দেয়া হয়। পরের বছর থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার ২৩ আগস্টকে কালো দিবস হিসেবে পালন করে আসছে।
দিবসটি ঘিরে ঢাবিতে একাধিক কর্মসূচি পালন করবে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ক্লাস বেলা ১১টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত বন্ধ থাকবে।
এ ছাড়া, কর্মসূচি অনুযায়ী এদিন সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা কালো ব্যাজ ধারণ করবেন। এ ছাড়া বেলা ১১টায় উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আখতারুজ্জামানের সভাপতিত্বে প্রশাসনিক ভবনে প্রফেসর আব্দুল মতিন চৌধুরী ভার্চুয়াল ক্লাসরুমে এক ভার্চুয়াল আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সামাদ, প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল এবং কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন আহমেদ অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন।
সূত্র: সময় টিভি
আপনার মতামত দিন